"বেদসংহিতাগুলো হচ্ছে প্রাচীন জ্ঞানবিজ্ঞানের আকর গ্রন্থ। বেদে দু’ধরণের জ্ঞানের কথা আলোচিত হয়েছে। অপরা ও পরা বিদ্যা।"
প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের আলোচনা করতে গেলে সেই জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমরা জানি যে বেদসংহিতাগুলো হচ্ছে প্রাচীন জ্ঞানবিজ্ঞানের আকর গ্রন্থ। বেদে দু’ধরণের জ্ঞানের কথা আলোচিত হয়েছে। অপরা ও পরা বিদ্যা। কোন কিছুই হঠাৎ গজিয়ে ওঠে না। আমাদের পূর্বপুরুষরাও নিশ্চয় একদিনেই বিশ্ব রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেন নি। প্রারম্ভিকভাবে তারাও হয়তো জড় বিজ্ঞানকে বুঝতে চেয়েছিলেন। জড় বা ভূতের অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে তাকে করায়ত্ব করেছিলেন। আর এই শক্তির দৌলতে তাঁরা জাগতিক ভোগসুখকেও নিজেদের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর হয়তো তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগল যে ভূত বা জড়বস্তুর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এত ভোগসুখ করায়ত্ব করা যায় কিন্তু সেই জড় বস্তু এল কোথা থেকে? কে সৃষ্টি করল এই জড়বস্তুকে? এই প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়েই তাঁরা মুখোমুখি হলেন এক অনির্বচনীয় আনন্দঘন সত্বার। এই সত্বাই তাঁদের ভাষায় পরমব্রহ্ম, অনাদি, আত্মা বা ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরকে কীভাবে উপলব্ধি করা যায় তার সাধনায় মগ্ন হলেন তাঁরা। বিজ্ঞান নিয়োজিত হল বিজ্ঞানঘন পুরুষকে জানবার হাতিয়ার হিসেবে। একসময় বিজ্ঞান আর দর্শনের ভেদাভেদ গেল ঘুচে। তবু দুটি ধারা চলল সমান্তরালভাবে।
মুন্ডুক উপনিষদের একটি শ্লোক থেকে জানা যায় যে পুরাকালে দুটি বিদ্যা আয়ত্ব করতে হত, পরা ও অপরা বিদ্যা। অপরা বিদ্যা হল ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। আর পরা বিদ্যা হল তাই যার সাহায্যে ব্রহ্মকে জানা যায়। প্রাচীন জ্ঞানের আদি উৎস হচ্ছে বেদ। ঋষিরা একথাও বলেছেন যে বেদে এই দু’ধরণের বিদ্যাই আছে। অপরা বিদ্যা, অর্থাৎ পৃথিবী ও তৃণাদি থেকে প্রকৃতি পর্যন্ত সব জড় পদার্থের গুণ জেনে তার সাহায্যে কাজে সিদ্ধ হওয়া যায় যে বিদ্যার সাহায্যে তাকেই বলা হয় অপরা বিদ্যা।
পরা বিদ্যা, যে বিদ্যার সাহায্যে সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্মকে জানা যায় তাকেই বলে পরা বিদ্যা। অর্থাৎ সমস্ত জড় পদার্থের গুণ জেনে সেই পদার্থের সাহায্যে আকাঙ্খিত কাজ করাকেই তাঁরা বলতেন অপরা বিদ্যা। এই জড় বিদ্যাকেই বিজ্ঞান বলা যায় আর এই বিজ্ঞানকে জানার পরেই যে বিদ্যার সাহায্যে বিজ্ঞানঘন পুরুষকে জানা যায় তাকেই বলা হয় পরা বিদ্যা।
এ সম্পর্কে ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়, প্রথম খন্ডের একটি কাহিনী থেকে জানা যায় যে নারদ সনৎকুমারের কাছে শিক্ষালাভের জন্য গেলে সনৎকুমার নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কী কী জান তা আমাকে বল। নারদ তখন বললেন, আমি ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, পৈত্রবিদ্যা, গণিত, দৈবশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, একায়ন, দৈববিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, জ্যোতিষ, সর্প ও দেবজনবিদ্যা অবগত আছি। আমি কেবল মন্ত্রবিৎ, আত্মবিৎ নই। নারদের কথা থেকে একথা বোঝা গেল যে তিনি পুঁথিগত জড় বিদ্যায় পন্ডিত কিন্তু আত্মবিৎ নন, অর্থাৎ আত্মা বা পরমেশ্বর সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ। অর্থাৎ তিনি অপরা বিদ্যায় পন্ডিত হলেও পরা বিদ্যা সম্পর্কে কিছু জানেন না। মনে হয় আজকের দিনে একজন আধুনিক বৈজ্ঞানিককে যদি সনৎকুমার এই একই প্রশ্ন করতেন তাহলে তিনিও নারদের মতই উত্তর দিতেন, আমি অপরা বিদ্যা জানি কিন্তু আত্মবিৎ নই। পুরাকালের জড়বিদ্যা বা অপরাবিদ্যাকে আধুনিককালের বিজ্ঞান বলা চলে।
অপরা বিদ্যা, বুদ্ধি বা intellect নির্ভর, কিন্তু পরাবিদ্যা নির্ভরশীল প্রজ্ঞার উপর। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় অনিল রায় তাঁর ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থে, ‘বুদ্ধি মানুষকে হিসেব দেয়, তা সহজবোধ্য; তার লাভ লোকসানের খতিয়ান বুঝতে দেরি হয় না। কিন্তু প্রজ্ঞা যে হিসেব দেয় তা ঘোরালো বলে ঠেকে, তা সূক্ষ্ম, দুর্বোধ তাই ধোঁয়াটে লাগে। বুদ্ধি তার যন্ত্রপাতি নিয়ে যেখানে মাপজোক করে, জরিপ করে সেখানকার পরিধি সঙ্কীর্ণ। প্রজ্ঞার যেখানে কারবার সেখানটা সীমাহীন, অতল। বুদ্ধি মানুষকে মাটির শক্ত পৃথিবীতে রাস্তা দেখিয়ে দেয় কিন্তু প্রজ্ঞা তার ডানায় করে উড়িয়ে নিয়ে যায়, অন্তহীন, বাধাহীন নীল আকাশে। বুদ্ধির বিচরণক্ষেত্র পরীক্ষিত। সেখানে সে নিশ্চিত নিঃসংশয়তার সঙ্গে নিরীক্ষণ, পরীক্ষা (observation, experiment)
করতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞার পরিক্রমণের ক্ষেত্রে অন্ধকারে ডুবে গিয়ে সব কিছুর সন্ধান করতে হয়, সেখানে দাঁড়াবার কঠিন ঠাঁই নেই। এইজন্য যা বুদ্ধির আবিষ্কার মানুষ তাকে সহজে গ্রহণ করে বিনা সন্দেহে। কিন্তু প্রজ্ঞার নির্দেশ গ্রহণ করতে মানুষের বহু সংকোচ, অনেক দ্বিধা। প্রজ্ঞার আশ্রয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে ধর্মকে আর বুদ্ধির সাহায্যে সৃজন করেছে বিজ্ঞানকে’।
সেই কোন অতীতকালে ভারতের মুনি ঋষিরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানব মনের এই দুই বিশিষ্ট গুণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে অবহিত ছিলেন। বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অন্যের পরিপূরক হয়েই মানুষকে সর্বাঙ্গীন কল্যাণের পথে চালিত করেছে। এরা কখনো পরস্পর বিরোধী হয়ে ওঠে নি। কিন্তু আধুনিক কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্যে বিরোধ। এ কখনই মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হতে পারে না।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী জৈল সিং বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে 1985 তে বলেছিলেন – বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার উন্নতি যে অনুপাতে বেড়েছে সে অনুপাতে মানুষের প্রজ্ঞা বাড়েনি। তাই মানবসভ্যতা আজ এক বিশ্বজোড়া বিপর্যয়ের শঙ্কায় মুহ্যমান। অস্ত্র প্রতিযোগিতা যত বাড়ছে ততই তীব্র হয়ে উঠছে এই ত্রাস। অন্যদিকে লাগামছাড়া কারিগরি উন্নতি মানুষকে ক্রমশ নীচের দিকে টানছে। মানুষ হয়ে উঠছে যন্ত্রের দাস, ভুলতে বসেছে মানবিক মূল্যবোধ। এইখানেই আজ বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানের মধ্যে সঞ্চার করে দিতে হবে মঙ্গলবোধ। আর সেই পথেই বিজ্ঞান ও অধ্যাত্মবাদের মধ্যে গড়ে উঠবে অচ্ছেদ্য সেতু। বিজ্ঞান ও অধ্যাত্মবাদ পরস্পর বিরোধী কখনই নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক’।
কলকাতার রামকৃষ্ণ ইনস্টিটিউট অফ কালচার এর 48 তম প্রতিষ্ঠা দিবসে (1985) ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার বলেন, ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক এবং দু’টিরই সূচনা ‘জিজ্ঞাসা’ থেকে’। তিনি আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তিটিও এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেন, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধের এবং ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খঞ্জের মতো। ড। নারলিকার আরও বলেন, ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়েই ভিন্ন পথে সত্যের সন্ধান করে চলেছে। এদেশে বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের পুনরজ্জীবনকে ধর্মীয় চেতনা ও জ্ঞানপুষ্ট করে তুলবে’।
পুরাকালেই বিজ্ঞান ও ধর্ম বা দর্শন আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়েছিল। সুতরাং পুরাকালে বিজ্ঞান ছিল না শুধু দার্শনিক চর্চ্চাই হত একথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। বেদ ছিল সেই বিজ্ঞান ও দর্শনের উৎস।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এইটুকুই বলতে পারি যে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করা ছাড়া আমাদের আর কোন দ্বিতীয় পথ বোধহয় নেই। (সংগৃহীত)*
লেখক – `নিরঞ্জন সিংহ
No comments:
Post a Comment