Thursday, June 25, 2015

নিরাময়: ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র



ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র (Diabetes)

 
 ডায়াবেটিস কোন ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয় এটি একটি বিপাকজনিত রোগ আমাদের পাকস্থলী সংলগ্ন ঠিক যেখান থেকে ুদ্রান্ত্রের শুরু সেখানে অগ্ন্যাশয় বা প্যাংক্রীয়াস (Pancreas) নামক একটি গ্রন্থি রয়েছে, যা থেকে ইনসুলিন নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় এই ইনসুলিন আমাদের গৃহিত খাবার থেকে সৃষ্ট গ্লুকোজকে ভেঙে শরীরের শক্তি উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগাতে সাহায্য করে কোন কারণে এই ইনসুলিনের অভাব হলে এর সম্পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতির কারণে শরীরে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় অর্থাৎ শরীর আর গ্লুকোজকে কাজে লাগাতে পারে না ফলে অতিরিক্ত গ্লুকোজ একসময় প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে এই সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলা হয় এই রোগে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়

 সুস্থ লোকের রক্তরস বা রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ থাকে অভুক্ত অবস্থায় . মিলি মোল-এর কম এবং খাওয়ার দুঘণ্টা পর . মিলি মোল-এর কম কিন্তু অভুক্ত অবস্থায় রক্তের প্লাজমায় গ্লুজোজের পরিমাণ . মিলি মোল বা তার বেশি হলে অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুঘণ্টা পরে রক্তের প্লাজমা বা রক্তরসে গ্লুকোজের পরিমাণ ১১. মিলি মোল বা তার বেশি হলে তাকে ডায়াবেটিস রোগ হিসেবে সনাক্ত করা হয় এই ডায়াবেটিস হলে অগ্ন্যাশয় থেকে প্রয়োজনমতো কার্যকরী ইনসুলিন নিঃসরণ হয় না বা এর কার্যকারিতা হ্রাস পায় বলে দেহে শর্করা, আমিষ চর্বি জাতীয় খাদ্যের বিপাকও সঠিক হয় না ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়
 রোগের লক্ষণ:
প্রথম অবস্থায় () ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া, () বার বার পিপাসা লাগা, () ঘামের পরিমাণ কমে যাওয়া, () মুখে প্রায় সবসময় মিষ্টি স্বাদ অনুভব করা
রোগ পুরাতন হলে () বেশি বেশি ক্ষুধা পাওয়া, () যথেষ্ট খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া, () ক্লান্তি দুর্বলতা বোধ করা, () মাথা ধরা, () মাথা ঘোরা, () কোষ্ঠকাঠিন্য, () মূত্রাশয়ে জ্বালা করা, () ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া, () খোশ-পাঁচড়া, ফোঁড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেওয়া, (১০) চোখে কম দেখা ইত্যাদি
কোন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন কি না, ব্যক্তির মূত্র রক্ত পরীক্ষা করে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়
 রোগের কারণ:
যে কেউ যে কোন বয়সে যে কোন সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন এর পেছনে প্রধান কারণই হচ্ছে অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ বা অন্যান্য হরমোনের আধিক্য হলে, কিংবা কোন ঔষধ বা রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে বা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার জটিলতার কারণে অগ্ন্যাশয় আক্রান্ত হয়ে এর কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে
স্বাভাবিকভাবে তিন শ্রেণীর লোকের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে-
() বংশে যেমন বাবা-মা বা রক্ত সম্পর্কীয় নিকট আত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে, () যাদের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ওজন বেশি এবং () যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কোন কাজ করেন না এছাড়া যারা সবসময় মানসিক দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন তাদেরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশিমাত্রায় থাকে
 রোগ নিরাময়ের উপায়:
সাধারণত ডায়াবেটিস রোগ সহজে সারে না তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে রোগ খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং তা নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রায় স্বাভাবিক কর্মঠ জীবন যাপন করা সম্ভব ক্ষেত্রে নিজের অবস্থা রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা নিয়ম-নীতি মেনে চলতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় পরামর্শ নির্দেশনা বাঞ্ছনীয় এটা সম্পূর্ণ বিপাকজনিত রোগ বলে খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে অতি সতর্ক থাকার বিকল্প নেই সাথে সাথে জীবনধারায় শৃঙ্খলাও অতি আবশ্যক
 ডায়াবেটিস রোগীর শরীরের ওজন বেশি থাকলে তা কমিয়ে এবং ওজন কম থাকলে বাড়িয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে এসে এই স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে চিনিজাত বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে শর্করা জাতীয় খাবার যেমন চাল আটা দিয়ে তৈরি খাবার, মিষ্টি ফল ইত্যাদি কিছুটা হিসাব করে খেতে হবে আঁশ জাতীয় খাবার যেমন ডাল, শাক-সবজী, টক ফল ইত্যাদি বেশি বেশি খেতে হবে সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার যেমন ঘি, মাখন, চর্বি, ডালডা, মাংস ইত্যাদি খাবারের বদলে অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার যেমন সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ তেল এবং সব ধরনের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে হবে চিকিৎসকের নির্দেশিত পরিমাণের বাইরে ক্যালরীবহুল খাবার খাওয়া যাবে না খাবার নির্দিষ্ট সময়ে খেতে হবে এবং কোন বেলায় খাবার বাদ দেয়া বা আজ কম কাল বেশি এভাবে খাবার খাওয়া উচিত হবে না তিতা জাতীয় খাবার যেমন নিয়মিত করলার রস খেলে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কম হতে পারে
 জীবনধারায় শৃঙ্খলা না মানলে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে তখন রক্তের প্রয়োজনীয় ইনসুলিন-সাম্যতা ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসক নির্দেশিত পরিমাণে ইনসুলিন ইঞ্জেকশান গ্রহণের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয় তবে -সবই সাময়িক ব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রে নিয়মিত পরিমাণমতো সুষম খাবার প্রয়োজনীয় ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম এই রোগ নিয়ন্ত্রণ নিরাময়ে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করা হয় ডায়াবেটিস রোগীদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না রাখলে এর উপজাত হিসেবে হৃদরোগসহ শরীরে বহু রোগের সৃষ্টি হতে পারে যা রোগীর জন্য অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে তাই সর্বাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ একান্ত বাঞ্ছনীয়
 যোগশাস্ত্রে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করতে প্রাচীন মুনিঋষিদের প্রবর্তিত কিছু নিয়ম যোগব্যায়াম অভ্যাসের উল্লেখ রয়েছে যেমন-
ভাত বা রুটির বদলে কাঁচকলা সিদ্ধ, মানকচু বা ওল সিদ্ধ খাওয়া অম্লধর্মী আমিষ জাতীয় খাদ্য, যথা- মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি গ্রহণ না করে ক্ষারধর্মী আমিষ জাতীয় খাদ্য, যথা- দই, ছানা, নারিকেল ইত্যাদি গ্রহণ করা নিম গাছের বাকল অথবা তেজপাতা ভেজানো জল খালিপেটে পান করলে বহুমূত্র রোগীরা দ্রুত ফল লাভ করে প্রথম দিন এক গ্লাস জলে ১টি তেজপাতা, পরের দিন ২টি, এভাবে ২১ দিনের দিন ২১টি তেজপাতাসহ জল পান করতে হবে পুনরায় ১টি করে কমিয়ে ২১ দিনের দিন ১টি তেজপাতা ভেজানো জল পান করতে হয় অর্থাৎ মোট ৪২ দিন পান করতে হয় পাশাপাশি কিছু যোগব্যায়াম অভ্যাস করা প্রয়োজন-
এই যোগ ব্যায়ামগুলো অভ্যাসের পূর্বে কিছু খালি হাতে ব্যায়াম বা সূর্য-নমস্কার ব্যায়াম অভ্যাস করে নিলে আরেকটু দ্রুত ফললাভ হয়
 উপরোক্ত খাদ্যতালিকা থেকে নিজ অভিরুচিমতে প্রস্তুত একটা নিয়ন্ত্রিত সুষম খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খাদ্যগ্রহণের সাথে সাথে নিয়মিত / মাস উল্লেখিত যৌগিক ব্যায়ামগুলো অভ্যাস করলে প্লীহা, যকৃত অগ্ন্যাশয় সুস্থ সক্রিয় হয়ে ওঠলে আমিষ শ্বেতসাত জাতীয় খাদ্য থেকে গ্লুকোজ তৈরি করে যকৃতে গ্লাইকোজেন রূপে সঞ্চিত করে রাখে এবং এই গ্লাইকোজেন দৈহিক নানা প্রয়োজনে যথাসময়ে ব্যয়িত হয়ে রোগীকে রোগমুক্ত করতে সহায়তা করে
এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সাথে অবশ্যই পরামর্শ করে নেয়া উচিত তাতে রোগমুক্তির জন্য তা আরো সহায়ক হবে। -- লেখকঃ রণদীপম বসু (সংগ্রহকৃত)